প্রবাসে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: সঞ্চয় ও ইনভেস্টমেন্টের সঠিক পথ
প্রবাস জীবন মানেই কি শুধু টাকা রোজগার আর অর্থ উপার্জন?
না। প্রবাসে আসার মূল উদ্দেশ্য শুধু অর্থ উপার্জন নয়, ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা। অনেকেই প্রবাসে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দেন, কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে আর্থিক দিক থেকে হোঁচট খান। কারণ, আয় থাকলেও সঞ্চয় ও বিনিয়োগ এর পরিকল্পনা না থাকলে অর্থ কখনোই আপনাকে স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে না।
এই লেখার মাধ্যমে আমরা জানবো, প্রবাসে থেকে কিভাবে সহজভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা যায়, নিয়মিত সঞ্চয় করে ও সঠিক ইনভেস্টমেন্ট কৌশলের মাধ্যমে ভবিষ্যতকে কিভাবে নিরাপদ করা যায়।
কেন আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা জরুরি?
প্রবাস জীবনের অনেকটাই অনিশ্চিত। চলুন যেনে নেই কি কি অনিশ্চয়তা থাকতে পারে।
- ওয়ার্ক ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে পারে
- হঠাৎ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে
- অসুস্থতা বা পারিবারিক কিংবা অন্যান্য কারণে দেশে ফিরে যেতে হতে পারে
এইসব অনিশ্চয়তার মধ্যেও যদি আপনার আর্থিক ভিত্তি শক্ত করে তৈরি করে রাখেন, তাহলে ভবিষ্যত নিরাপদ থাকে। এজন্য দরকার:
- সচেতনতা
- লক্ষ্য নির্ধারণ
- এবং ধাপে ধাপে পরিকল্পনা
প্রথমে আসি লক্ষ্য নির্ধারণ: কোথায় যেতে চাই?
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা শুরু হয় লক্ষ্য নির্ধারণ থেকে। নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন:
- আগামী ৫ বছরে কী কী অর্জন করতে চাই?
- দেশে ফিরে গিয়ে কী ব্যবসা বা কাজ করতে চাই?
- পরিবারের জন্য কী ধরনের সাপোর্ট চাই?
- কী পরিমাণ টাকা থাকলে আপনি নিরাপদ অনুভব করবেন?
উদাহরণস্বরূপ:
- ২০ লাখ টাকা সঞ্চয়
- ১টি প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয়
- দেশে একটি ছোট ব্যবসা করার মূলধন
এখন সেই লক্ষ্য অনুযায়ী আপনি মাসিক কিংবা বার্ষিক পরিকল্পনা করতে পারবেন।
সঞ্চয় (Saving): আপনার প্রথম ধাপ
১. প্রথমে একটি মাসিক বাজেট তৈরি করে নিন
প্রতি মাসে আপনি কত টাকা আয় করেন এবং তার কতটুকু খরচ হয় — এটি লিখে রাখুন।
উদাহরণ:
- আয়ঃ ২০০০ রিয়াল
- খরচ (বাসা ভাড়া, খাওয়া, যাতায়াত, কিংবা অন্যন্য খরচঃ ৫০০ রিয়াল
- বাড়িতে পাঠাবেনঃ ৬০০ রিয়াল
- তাহলে সঞ্চয় থাকলো ৯০০ রিয়াল
লক্ষ্য রাখুন, আয় যতই হোক, অন্তত ২০–৩০% অবশ্যই সঞ্চয় করুন।
২. “সঞ্চয় আগে, খরচ পরে” এই নিয়ম অনুসরণ করুন
বেশিরভাগ মানুষ মাস শেষে বেঁচে যাওয়া টাকা সঞ্চয় করেন। এটি ভুল পদ্ধতি। চলুন না পদ্ধতিটাই একটউ পরিবর্তন করে দেখি।
আপনার মাসিক ইনকাম থেকে সঞ্চয়ের টাকা প্রথমেই আলাদা করে রাখুন। আর বাকিটা দিয়ে আপনার যাবতীয় কাজ, খরচ, এবং বাড়ির জন্য পাঠাবেন।
৩. সঞ্চয়ের জন্য আলাদা একাউন্ট রাখুন
দেশে বা বিদেশে একটি আলাদা একটি সেভিংস একাউন্ট খুলে সেখানে শুধু সঞ্চয়ের জন্য টাকা জমান। এই একাউন্ট থেকে কখনই কোনো টাকা খরচ করবেন না এই সংকল্প করুন।
ইনভেস্টমেন্ট (Investment): টাকাকে দিয়ে কাজ করান
সঞ্চয় হচ্ছে টাকা জমিয়ে রাখা, আর ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে টাকাকে এমন জায়গায় লাগানো যেখানে আপনার টাকা বাড়বে।
চলুন যেনে নেওয়া যাক কি কি ধরনের ইনভেস্টমেন্ট আপনি করতে পারেন।
১. স্বল্প ঝুঁকির ইনভেস্টমেন্ট
- এফডিআর (FDR): ব্যাংকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা রেখে দিন, এতে আপনার টাকা বাড়বে, এবং ইনভেস্টমেন্ট এর জন্য এটাই সবচাইতে নিরাপদ এবং জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে আমার পরামর্শ এটাতে আপনি না যেতে পারেন। আমি শুধু অপশনটা বললাম, দিন শেষে এটা কিন্তু সুদ (হারাম।)
- সঞ্চয়পত্র নিতে পারেন। এটা একটি পোস্ট অফিস স্কিম এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ ও লাভজনক।
২. সম্পদ কেনা
- গ্রামে কিংবা শহরে প্লট বা জমি কিনে রাখতে পারেন ভবিষ্যতে জমির দাম বাড়ে। তবে যাচাই করে বুঝে শুনে কিনুন।
- গোল্ড বা সোনা তে ইনভেস্ট করতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদে সোনার দাম সাধারণত বাড়ে। ছোটো করে প্রথমে শুরু করতে পারেন আস্তে আস্তে কিছুনা কিছু কিনে রাখলেন।
৩. ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট (আপনার যদি জানা থাকে)
- মিউচুয়াল ফান্ড ইনভেস্ট করতে পারেন পেশাদার ব্যবস্থাপনায় স্টকে বিনিয়োগের ব্যবস্থা এটি।
- স্টক মার্কেটে ইনভেস্ট করতে পারেন যদি জ্ঞান ও সময় থাকে আর যদি রিস্ক নিতে পারেন আপনি।
একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, অন্ধভাবে কাউকে বিশ্বাস করে ইনভেস্ট করতে যাবেন না।
কিছু কার্যকর কৌশল ও টিপস
১. খরচের হিসাব রাখুন
প্রতি মাসে কোন খাতে কত খরচ হচ্ছে তা লিখে রাখুন। এতে করে আপনার অপ্রয়োজনীয় খরচ কি তা জানতে পারবেন এবং খরচ কমাতে পারবেন।
২. খরচ কমান, জীবন নয়
প্রবাসে থাকার সময় অনেকেই দেখানোর জন্য খরচ করেন। বাস্তবতা হলো, অর্থনৈতিক স্থিতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কাউকে না দেখিয়ে নিজের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো সমৃদ্ধ করুন।
৩. সময় মতো পরিবারে টাকা পাঠান, নিজের ভবিষ্যত ভুলে না গিয়ে
পরিবারে খরচ পাঠানো জরুরি, তবে একি সাথে নিজের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করাটাও কিন্তু জরুরি। দুটোকেই আপনাকে ব্যালেন্স করতে হবে।
প্রবাস জীবনের সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে করবেন?
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট নিজের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করুন
- নতুন কিছু কিংবা নতুন স্কিল শিখার চেষ্টা করুন (ফিনান্স, ব্যবসা, ইনভেস্টমেন্ট)
- নিজের জন্য ইমারজেন্সি ফান্ড তৈরি করুন (Emergency Fund)
- দেশের জন্য একটি স্বপ্ন গড়ে তুলুন যেটা আপনার ভবিষ্যতে কাজে লাগবে যেমন ধরুন (ব্যবসা, ফার্ম,কিংবা রিয়েল এস্টেট)
শেষ কথা
প্রবাস জীবনের আয় যদি আপনার ভবিষ্যতের জন্য কাজ না করে, তাহলে তা শুধু কষ্ট আর সময়ের অপচয় হবে। আপনার সঠিক পরিকল্পনা, সঞ্চয় ও ইনভেস্টমেন্ট এবং আপনার দূরদর্শিতা আপনাকে একটি স্বাধীন ও আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যত দিতে পারে।
আজই একটি খাতা নিন, নিজের আয়-ব্যয় লিখুন এবং একটি লক্ষ্য ঠিক করুন। ছোট পদক্ষেপ থেকেই বড় পরিবর্তন শুরু হয়।
কী আপনি ইতিমধ্যেই কোনো ইনভেস্ট করছেন? নাকি এখনো শুরু করবেন ভাবছেন? নিচে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!